রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভাষা আন্দোলন থেকে গণজাগরণমঞ্চ

 

মাহবুবুল আলম চুন্নু 


ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, খ্যাতিমান সাংবাদিক, প্রগতিশীল সাহিত্যিক, বাংলাদেশের আপোষহীন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মহান দিকপাল পরম শ্রদ্ধেয় মহামতি কামাল লোহানী ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
ব্রিটিশ শাসনাধীনে জন্মের পরই তিনি ক্ষুদ্ধ স্বদেশ দেখতে পান। তারপর পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক দুঃশাসন। বিখ্যাত লোহানী পরিবারে জন্মই তাঁকে পরবর্তীতে আন্দোলনমুখী করে তোলে। গণমানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের হাতে খড়ি হয় বাল্যবয়সেই।



১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়েই মূলত তাঁর প্রতিবাদী হয়ে ওঠা। ১৮ বছর বয়সেই তিনি ভাষার দাবীতে জেল খাটেন।
শুরু হয় সংগ্রামী জীবন।
পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন বন্ধের ঘোষণা দিলে তরুণ কামাল লোহানী সানজিদা খাতুনের নেতৃত্বে ছায়ানট গঠন করে রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হলে তিনি এর প্রধান বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরশাসন, সেনাশাসন ও প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন।

গত শতকের ৮০ র দশকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠন করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অস্থির সময়ে মঞ্চে ও রাজপথে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংগঠিত করে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার – আলবদরদের বিচারের দাবীতে অধ্যাপক জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত গঠনেও তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন।
পরবর্তীতে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে তরুণ প্রজন্মের ব্যাপক অংশগ্রহণে গণজাগরণ মঞ্চ গঠনেও তিনি কার্যকর ভূমিকা রাখেন। মঞ্চে থেকে যুদ্ধাপরাধী – লুটেরা – দূ্র্বৃত্তদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী শ্লোগান ও বক্তব্য দিয়ে তিনি সারা দেশের তরুণ – যুবাদের চেতনার পিদিমে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করেন। স্বাধীনতাপূর্বকালে পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রচিত ও প্রচারিত শ্লোগানগুলো —- ” তুমি কে, আমি কে, — বাঙালী – বাঙালী ; তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা – মেঘনা – যমুনা ” ইত্যাকার উদ্দীপক শ্লোগানগুলো তরুণদের কন্ঠে তুলে দিয়ে সমগ্র বাঙালী জাতির চেতনাকে নবরূপে শানিত করায় তাঁর অবদান অপরিসীম। যদিও পরবর্তীতে কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্রান্তে ” গণজাগরণ মঞ্চ ” বন্ধ হয়ে যায়।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আদর্শিক সংগঠন ” উদীচী ” এর সভাপতির পদ অলংকৃত করে এদেশের সুষ্ঠু সংস্কৃতি চর্চা এবং ধারাকে বেগবান করেন।
চির সংগ্রামী কামাল লোহানী ২০ জুন ২০২০ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।
কামাল লোহানী বাঙালী জাতিসত্তার স্বাধীন ও বিপ্লবী বিকাশ এবং সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা আমৃত্যু উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। সত্য ও ন্যায়ের ঝান্ডা উড়াতে উড়াতেই তিনি আমাদের মাঝ থেকে চির বিদায় নিয়েছেন।

তাঁর সংগ্রামী জীবন নতুন প্রজন্মের চেতনায় মঙ্গলপ্রদীপ হয়ে জ্বলবে। কামাল লোহানীদের আদর্শের মৃত্যু নেই ।


মাহবুবুল আলম চুন্নু 

কলামিস্ট,সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

Comments are closed.

More News Of This Category